যারা তালেবানি অত্যাচার চাক্ষুষ করেননি, যারা শুধুমাত্র গল্পে এবং সিনেমায় তালেবানি অত্যাচারের কথা দেখেছেন বা শুনেছেন, তারা একবার ঘুরে আসুন দিল্লির ভোগালে।
এক চিলতে ভাড়ার ঘরে এক মাঝবয়সী মহিলার একাকী জীবনযাপন। তবুও এ জীবন বড্ড সুখের, বড্ড শান্তির, বলছেন ফরিবা। তিনি এক তালেবানি যোদ্ধার স্ত্রী। বলা ভালো, প্রাক্তন স্ত্রী। মাত্র প্রায় ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন দুই কন্যা সন্তানের মা হলেন, তখন দুই শিশু কন্যাকে বিক্রি করে দিল তাদের তালেবানি বাবা। জীবনের এমনই অভিজ্ঞতা বহন করে চলেছেন তালেবানি সৈনিকের স্ত্রী ফরিবা। গত ২৬ বছর ধরে তালেবানি অত্যাচারের স্মৃতি বহন করে আজ একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর জীবনকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফারিবা। ভারতীয় একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে ফারিবার তালেবানি অত্যাচারের এমন স্মৃতি।
ফরিবার সারা শরীর জুড়ে এখনও সেই অত্যাচারের হাজারো চিহ্ন। ভারতে পালিয়ে এসে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি। কুলুঙ্গিতে বইয়ের ভাঁজে আজও রাখা আছে পুরনো দিনের একটি ছবি। সে ছবি দুটি আঙুলের। ক্ষতবিক্ষত আঙুল দুটি সেলাই করার পর ছবি তুলে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তালেবানি অত্যাচারের কথা মনে রাখতে ছবিটি আগলে রেখেছেন ফরিবা। এমন ক্ষত ফরিবার শরীর জুড়ে।
দিল্লির লাজপতনগর সংলগ্ন ভোগালে জিম প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে ফরিবার। প্রায় দু’দশক পরে ফের আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন কায়েম হওয়ার পর রাগে ক্ষোভে জ্বলছেন ফরিবা। তার কথায়, ‘গুলি কোথায় লাগল তা দিয়ে কী এসে যায় ! তালেবানরা আস্ত বারুদের স্তুপ। যারা জীবনে একবার তাদের সম্মুখীন হয়েছে তারাই তাদের চেনে। তালেবানরা কখনও ভালো হতে পারে না। নৃশংস অত্যাচারী তালেবানদের কখনও মেনে নিতে পারিনি, ভবিষ্যতেও মেনে নিতে পারবো না।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখের জল বাধ মানছিল না ফরিবার। আকাশের দিকে তাকিয়ে তালিবান সেনার প্রাক্তন স্ত্রী বলছিলেন, ‘ওরা যতই বদল এবং পরিবর্তনের কথা বলুক তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওরা গোটা বিশ্বকে বোকা বানাতে চাইছে। আমি নিজে তালেবানদের মধ্যে থেকে তালেবানদের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছি। আমার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমার উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। আমার গর্ভের দুই সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছে। সবের পিছনেই তালেবান, তালেবানি প্রশিক্ষণ এবং মগজ ধোলাই।’
আফগানিস্তানের এক হতদরিদ্র পরিবারের জন্ম ফরিবার। দারিদ্রের কারণে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন তার বাবা-মা। আফগানিস্থানে মেয়েদের সেই স্বাধীনতা নেই যে তারা নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে পারে। নিজের থেকে কুড়ি বছরের বড় এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফরিবার।
আর বিয়ের পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রবল অত্যাচার। ফরিবা জানিয়েছেন, বিয়ের কয়েক বছর পর একে একে দুই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের বড় মেয়েকে বিক্রি করে দেন ফরিবার তালিবানি স্বামী। স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের পায়ে ধরে কেঁদে লুটিয়ে পড়ে ছিলেন ফরিবা। চরম অমানবিক তালেবানি স্বামী ও তার পরিবারের লোকেরা পরিবার সেদিন চোখের জল মোছাতে আসেনি। গর্ভজাত সন্তানকে বিক্রি হয়ে যেতে দেখে ভেঙে পড়েছিলেন ফরিবা।
এখানেই অবশ্য শেষ নয়। এরপরের অধ্যায়টি শুনলে শিউরে উঠতে হয়। ফরিবা বলছিলেন, ‘এরপর আমার ছোট মেয়েটিকে বিক্রি করার চেষ্টা করে আমার স্বামী। আমার মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরদিন সকালে আমার সেই মেয়েকে নিয়ে আমার স্বামী কোথাও বেরিয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মেয়ের কোনো খবর আমি জানতে পারিনি। আমার স্বামী তালেবানি যোদ্ধা ছিল। তালিবানদের ইশারায় ওঠবস করত। খুব সম্ভবত তালেবানদের ডেরায় ছেড়ে এসেছিল আমার মেজো মেয়েকে।’